মুহা. ফখরুদ্দীন ইমন, চৌদ্দগ্রামপ্রতিনিধি:
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথদীঘিতে মাছ না থাকার বিষয়টি গোপন রেখে বড়শি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে কর্তৃপক্ষ। প্রতারণার মাধ্যমে প্রতিযোগিদের নিকট থেকে অন্তত ২৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে তারা। এমন জঘন্য অভিযোগ উঠেছে দীঘির ইজারাদারদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনার মূলহোতা হিসেবে জগন্নাথদীঘির ইজারাদার চিওড়া মৎস্য চাষী সমিতির সভাপতি মো. ফখরুল ইসলাম ফয়সালের নাম উঠে এসেছে। এভাবেই সৌখিন মৎস্য শিকারীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অপচেষ্টা চালাচ্ছে এ চক্রটি। অথচ প্রতিযোগীতার মাধ্যমে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করা সৌখিন শিকারী ও সাধারণ মৎস্য প্রেমিদের পছন্দের কাজ। এটাকে পুঁজি করেই আজ একটি চক্র তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত। কিন্তু মৎস্য শিকার করতে আসা মানুষগুলো জানেই না আদৌ পানির নিচে সেই কাঙ্খিত বিশাল আকৃতির মাছটি আছে কিনা। অজানার মধ্যেই প্রতিযোগীতার নির্দিষ্ট সময় পেরোলেই তারা হতাশা মধ্যে নিমজ্জিত হবে। এমনই চাঞ্চল্যকর একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথদীঘিতে। মাছ শূণ্য এই দীঘিতে আগামী ১০ অক্টোবর (শুক্রবার) ২৪ ঘন্টা ব্যাপী বড়শি প্রতিযোগীতার আয়োজনের প্রায় শেষ প্রস্ততি সম্পন্ন। হরদম চলছে মৎস্য শিকারীদের রেজিস্ট্রেশনের কাজ। প্রতিটি টিকেটের দাম ২৮ হাজার টাকা হারে নির্ধারণ করার পর ইতিমধ্যে শতাধিক টিকেট বিক্রির গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। শতাধিক টিকেট বিক্রির কথাটি সত্য হলে কর্তৃপক্ষ অন্তত ২৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলেই অনুমান করা যাচ্ছে। অনেকেই আবার ৫ হাজার টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। শুক্রবার এসে বাকী টাকা জমা দিয়ে প্রতিযোগিতায় নামবেন। এছাড়াও প্রশাসনিক জটিলতা এড়াতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আমলাসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য বিনামূল্যের টিকেটের সু-ব্যবস্থার বিষয়টিও বিভিন্নভাবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু কেউই জানে না দীঘিটি যে একেবারেই বড় মাছ শূণ্য। দীঘি ইজারা নেওয়া “চিওড়া মৎস্য চাষী সমবায় সমিতি লি:” এর সাধারণ সম্পাদক মো. সফিউল ইসলাম জিয়া মাছ শূণ্য দীঘিতে বড়শি প্রতিযোগীতার নামে মৎস্য প্রেমিদের সাথে প্রতারণা ও মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা বন্ধের দাবি জানিয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর পৃথক লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। তিনি অবিলম্বে প্রতারণামূলক এ কার্যক্রম বন্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
দায়েরকৃত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তের ফলে জগন্নাথদীঘিটি অভিভাবক শূণ্য হয়ে পড়ে। হামলা-মামলার ভয়ে জগন্নাথদীঘির পূর্বের ইজারাদার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী সদস্য ও বিশিষ্ট ঠিকাদার মো. মহিবুল আলম মজুমদার কানন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। যারফলে স্থানীয় প্রভাবশালী কতিপয় লোকজন ও এলাকার সাধারণ মানুষ দফায় দফায় জাল পেলে দীঘি থেকে পূর্বে চাষকৃত বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় মাছগুলো লুটপাট করে নিয়ে যায়। চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত কোন ধরনের বাঁধা-বিপত্তি ছাড়াই যে যার মত করে দীঘি থেকে মাছ ধরে নিয়ে যায়। একারণেই বলা চলে দীঘিটি এখন মাছ শূণ্য প্রায়। চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল জগন্নাথদীঘিটি “চিওড়া মৎস্য চাষী সমবায় সমিতি লি:” বিধি মোতাবেক ৫ বছরের জন্য ইজারা নেয়। লিজ নেওয়ার পরপরই তারা দীঘিতে বিভিন্ন প্রজাতির বিপুল সংখ্যক মাছের পোনা অবমুক্ত করে। মাত্র ৪/৫ মাসের ব্যবধানে সেই নতুন করে অবমুক্ত করা মাছগুলো বলতে গেলে এখনও খাওয়া বা বিক্রির উপযোগীও হয়নি। কিন্তু জগন্নাথদীঘী মানে বৃহত্তর কুমিল্লার বড় ও ঐতিহ্যবাহী দীঘি। এটিকে পুঁজি করেই মাছ শূণ্য থাকার বিষয়টি আড়াল করে তড়িঘড়ি করে বড়শি প্রতিযোগীতার নামে মৎস্য প্রেমিদের পকেট থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিতে এমন প্রতারণামূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে সমিতির সভাপতি মো. ফখরুল ইসলাম প্রকাশ ফয়সাল। সে চট্টগ্রামের বারৈয়ারহাট হ্যাচারী থেকে লোক দেখানো স্বল্প পরিমাণে কিছু বড় মাছ এনে তা দিঘীতে ছাড়ে এবং ভিডিওধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এছাড়াও চটকদার বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে মাছ শিকারীদের বিভিন্ন গ্রæপে তা ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আকৃষ্ট করে ২৮ হাজার টাকা হারে টিকেট বিক্রি শুরু করে। অথচ অতীতে কখনো এই দীঘিতে ৫ হাজার টাকার উপরে বড়শি প্রতিযোগিতার টিকেটের মূল্য ছিলনা। এভাবেই ফখরুল ইসলাম ফয়সাল প্রায় ২৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হোসেন জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের দিন থেকে টানা ৮/৯ মাস স্থানীয়রাসহ দূর-দূরান্তের শত শত মানুষ দীঘির মাছ লুটপাট করে নিয়ে যায়। দীঘির বর্তমান ইজারাদাররা গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে দীঘি বুঝে নেওয়ার পর কিছু মাছের পোনা অবমুক্ত করে। কিন্তু বড়শি প্রতিযোগীতা দেওয়ার মত বড় মাছ দীঘিতে নেই। এটা জোচ্চুরি।
দীঘিরপাড়ের বাসিন্দা শামছুল হক জানান, চৌদ্দগ্রামসহ আশে-পাশের সবাই জানে দীঘিতে কোন মাছই নেই। তাই ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী এলাকায় লিফলেট ছাপিয়ে তাদের আকৃষ্ট করে উচ্চমূল্যে টিকেট বিক্রি করে বড়শি প্রতিযোগিতার নামে মাছ শিকারীদের সাথে প্রতারণা করছে ইজারাদার ফয়সাল।
জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের কেছকিমুড়া গ্রামের হানিফ মিয়া জানান, মাছ শূণ্য দীঘিতে বড়শি প্রতিযোগীতার আয়োজনের বিষয়ে আমরা কয়েকজন মো. ফখরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি আমাদের ধমক দিয়ে বলেন, তোমাদের এত কথা বলার দরকার নেই। এখানে ফেনী, কুমিল্লার ডিসি-এসপি, সচিবসহ অনেক উচ্চ পর্যায়ের লোক উপস্থিত থাকবে।
চিওড়া মৎস্য চাষী সমবায় সমিতি লি: এর সাধারণ সম্পাদক মো. সফিউল ইসলাম জিয়া জানান, দীঘিটি লিজ নেওয়ার পর থেকেই আমাদের সমিতির সভাপতি ফখরুল ইসলাম ফয়সাল কিছু কুচক্রি মহলের ইদ্ধনে নানান টালবাহানা শুরু করেন। সে মানুষ ঠকানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এসব বিষয় নিয়ে তার সাথে আমাদের সমিতির অপরাপর সদস্যদের মতবিরোধ তৈরী হয়। দীঘি ইজারা নেওয়ার মাত্র ৫ মাসের মাথায় ফখরুল ইসলাম একক সিদ্ধান্তে বড়শি প্রতিযোগীতার নামে মানুষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে। সাধারণ মানুষের সাথে ঘটা এমন অন্যায় কাজ আমি মেনে নিতে পারছিনা বলে উক্ত বড়শি প্রতিযোগীতা বন্ধের জন্য কুমিল্লা জেলা প্রশাসক ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর পৃথক লিখিত আবেদন করেছি। আশা করি এমন প্রতারণামূলক কার্যক্রম বন্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত “চিওড়া মৎস্য চাষী সমবায় সমিতি লি:” এর সভাপতি ফখরুল ইসলাম ফয়সাল বলেন, আমার চাষকৃত অন্য দীঘি থেকে মাছ এনে জগন্নাথদীঘিতে ফেলা হয়েছে। ইজারা নেওয়ার মাত্র ৫ মাসের মাথায় অভিনব এমন প্রতিযোগীতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমরা ইতিমধ্যে দীঘিতে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছি। লগ্নিকৃত সে টাকা তো এখান থেকে ব্যবসা করেই তুলতে হবে। এটাই আমার বিজনেস।
এ বিষয়ে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: জামাল হোসেন জানান, ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে দীঘিটি লিজ দেওয়া হয়েছে। মাছ শূণ্য দীঘিতে বড়শি প্রতিযোগীতার নামে মৎস্য শিকারীদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে এমন একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। সেই আলোকে উপজেলা সমবায় অফিসারকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বলা হয়েছে।