মুহা. ফখরুদ্দীন ইমন, চৌদ্দগ্রাম প্রতিনিধি:
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে অতিথিবিহীন আলোচিত বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত উপজেলার কনকাপৈত ইউনিয়নের তারাশাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক পরিষদের সভাপতি, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মো. কামরুজ্জামানের বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সকালে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক কামরুজ্জামান নিজেই আয়োজন করেন বিদায় সংবর্ধনার। অথচ তার অনুষ্ঠানে আসেনি ব্যানারে দৃশ্যমান কোনো অতিথি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিনব এ প্রতিবাদ করায় তালিকায় নাম থাকা অতিথি ও প্রতিবাদী বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি সহ কমিটির অন্যান্য সদস্যদের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন স্থানীয়রা।
গত সোমবার ও মঙ্গলবার বিভিন্ন মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর বিদায় আলোচিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যায়নি প্রধান অতিথি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বিশেষ অতিথি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ।
বিদ্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর মো. কামরুজ্জামান তারাশাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর থেকে তিনি বিভিন্নভাবে আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৯ সালে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির অভ্যন্তরীন এক হিসাব নিরীক্ষায় ৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৫৬ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। পরে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য, সাবেক রেলপথ মন্ত্রী মো. মুজিবুল হকের মধ্যস্থতায় ৪ কিস্তিতে বিদ্যালয়কে ৪ লাখ টাকা পরিশোধের শর্তে বিষয়টি দফারফা হয়।
এরপর কামরুজ্জামান বিদ্যালয় তহবিলে ২ কিস্তি পরিষদের পর ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হলে তিনি বিদ্যালয় ফান্ডে আর কোনো টাকাই জমা দেননি। এদিকে বর্তমান পরিচালনা কমিটি ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত অভ্যন্তরীন নিরীক্ষা করে ১৪ লাখ ৬ হাজার ৭৮১ টাকা আত্মসাতের প্রমান পান। এরপর বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শাহআলম মজুমদার গত ৩০ সেপ্টেম্বর লিখিতভাবে প্রধান শিক্ষক মো. কামরুজ্জামানকে নিরীক্ষা কপিসহ কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানোর দুই সপ্তার পরও তিনি কোনো জবাব দেননি। বরং তড়িগড়ি করে নিজ উদ্যোগে মঙ্গলবার নিজের শেষ কর্মদিবসে বিদায়ী সংবর্ধনার আয়োজন করেন। এরই মধ্যে বিষয়টি জানাজানি হলে স্থানীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
আয়োজিত অনুষ্ঠানের ব্যানারে প্রথমে ইউএনও, শিক্ষা অফিসার, জামায়াত নেতৃবৃন্দ ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের নাম উল্লেখ করা হয়েছিলো। এনিয়ে মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের পর ও জামায়াতের প্রেসারে নেতৃবৃন্দের নাম বাদ দিয়ে ইউএনও, শিক্ষা অফিসার ও সভাপতির নাম রাখা হয় ব্যানারে। তবে ব্যানারে উল্লেখিত কোন অতিথি এবং বিদ্যালয়ের সভাপতি বিদায়ী সংবর্ধনায় আসেননি।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যালয় পরিচালনা অ্যাডহক কমিটির অভিভাবক সদস্য মতিউর রহমান সুমন, শিক্ষক প্রতিনিধি আলমগীর আলম মাঝি, উপজেলার অন্যান্য বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে জামাল হোসেন, ইফতেখারুল আলম, মোহাম্মদ আলী হোসাইন, জসিম উদ্দীন, আরশাদ উল্যাহ, আবুল হাশেম, শাহজাহান কবির।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, মো. কামরুজ্জামান দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য মুজিবুল হকের সহযোগীতায় ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর তারাশাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। ওই সময়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে পরিচালনা কমিটির একাংশের সাথে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সৃষ্ট বিরোধের ঘটনায় প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির পক্ষের সন্ত্রাসীরা দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র মুকতার আহমেদ চৌধুরীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করেছে।
ওই ঘটনার প্রতিবাদে পাঁচ দিন পর্যন্ত অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন এবং সন্ত্রাসীদের শাস্তির দাবিতে ওই বছরের ৯ থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ৩টি বিষয়ে নির্বাচনী পরীক্ষা ও অন্যান্য শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জনসহ শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয়। ওই সময়ে তিনি উপজেলা আওয়ামীলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক থাকায় দলীয় প্রভাব খাটিয়ে আন্দোলন দমন করেন। এরপর তিনি বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাতসহ নানান অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম মজুমদার বলেন, ‘সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। প্রধান শিক্ষক নিজেই নিজের সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন। তাছাড়া আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তাই, প্রধান শিক্ষককে বিদায় সংবর্ধনা দেয়ার প্রশ্নই আসে না।’
মঙ্গলবার বিকেলে বিদায় অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা একেএম মীর হোসেন বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেহেতু অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি, সে কারণে অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়নি। তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত কমিটি করে প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুসারে বিধিগত ব্যবস্থা নেয়া হবে’।