নেকবর হোসেন
কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার ডুমুরিয়া গ্রামের সন্তান অমিত কুমার সরকার। পেশায় ব্যবসায়ী। দুই ভাইয়ের মধ্যে অমিত বড়। ঘুমের মধ্যে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ছোট ভাই আশিক সরকার গত হয়েছেন তিন বছর আগে। প্রবাসী পিতা দিলীপ সরকার ও গৃহিনী মাতা রাধা রাণী সরকার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন অমিতকে আঁকড়ে ধরে ছোট ছেলের শোক ভুলার চেষ্টা করেন।
দেখতে দেখতে অমিতের বিয়ের বয়স হয়েছে। পিতা দিলীপ সরকার ধুমধাম করে ছেলেকে বিয়ে করাবেন এই স্বপ্ন নিয়ে দীর্ঘ ৩০ বছরের প্রবাসী জীবনের ইতি টেনে দেশে ফিরেন এবং ছেলের ব্যবসায় সময় দেন। ছেলে অমিত এর বিয়ে ঠিক করেন নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার ভিংরাব গ্রামে।
পঞ্জিকার -এরপর ৪ এর পাতায়।
তিথি অনুযায়ী ১৫ শ্রাবন (৩১ জুলাই) বৃহস্পতিবার অমিত এর বিয়ের দিন পাকা হয় গত ৩ মাস আগে। সেই অনুযায়ী বুধবার গ্রামের বাড়িতে অমিত এর গাঁয়ে হলুদ, বৃহস্পতিবার সকালে বিয়ে বাড়িতে বাদ্যযন্ত্রের সাথে সানাইয়ের সুর। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ অতিথিদের উপস্থিতিতে ভরপুর। বিকেলে মঙ্গল ঘট স্থাপন করে সন্ধ্যায় ধুতি, পাঞ্জাবির সাথে মাথায় মুকুট পড়ে চন্দনের ফোঁটায় বর সেঁজে মায়ের কোল ছেড়ে রওয়ানা করেন অমিত। বরযাত্রী নিয়ে রূপগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছুটে অমিত এর বিয়ের গাড়ি বহর। নতুন বউ নিয়ে ছেলে বাড়ি ফিরবে এই স্বপ্ন নিয়ে বসে আছেন মা রাধারাণী। রাত ১০টায় বরযাত্রীর গাড়িবহর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার গৌরীপুর পৌঁছার পর বুকের প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করেন বর অমিত। দ্রুত তাকে গৌরীপুরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি ঘটলে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে নেয়। রাত ২টায় কনে বাড়ি পৌঁছার আগে পরপারে পাড়ি জমান অমিত।
ওইদিকে, কনে বাড়িতে চলছিল বিয়ের ব্যাপক আয়োজন। বরযাত্রী আসতেছে, আপ্যায়ণ করতে হবে। কিন্তু বরযাত্রী আসার অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না। রাত গভীর হচ্ছে বর ও বরযাত্রী কারও দেখা নেই। বিয়ের লগ্ন পেরিয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করে কনে পক্ষের। ফোন আসতে থাকে বরের অভিভাবকদের কাছে। সবকিছু জেনে শোকে স্তম্ভিত কনের বাড়ি।
সব কিছু ঠিক থাকলে শুক্রবার (১ আগস্ট) ভোরে সুসজ্জিত প্রাইভেটকার যোগে নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতো অমিত। মা-বাবাকে দেখাতো পুত্রবধুর মুখ। কিন্তু নিয়তির নির্মমতায় শুক্রবার ভোরে সুসজ্জিত প্রাইভেটকারের স্থলে এ্যাম্বুলেন্স যোগে নিথর দেহে একাই বাড়ি ফিরেন অমিত! তখনও মুছেনি কপালে থাকা চন্দনের ফোঁটা। বরবেশে ছেলের সাদাকাপড়ে মোড়ানো নিথর দেখে বাকরূদ্ধ মা-বাবা। শোকে বিহ্বল গোটা পরিবার।
দুপুরে অমিতকে শেষবারের মতো বিদায় দিতে করানো হয় গোসল। আবারও সাজানো হয় নতুন সাজে। ধর্মীয় রীতি অনুস্মরণ করে পারিবারিক সমাধিস্থলে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় তাকে।
তিন বছরের মধ্যে দুই ছেলেকেই হারিয়ে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন মা রাধারাণী। কেঁদে বুক ভাসিয়ে চিৎকার করে বলছেন- ‘বাবা তোরা আমাকে কোথায় রেখে গেলি। আমরা এখন কারে নিয়ে বাঁচবো। হে ভগবান… কি অপরাধ ছিল আমাদের, কেন বুকের ধনকে কেড়ে নিলে….’।
এদিকে, অমিত এর মৃত্যুর খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আবেগায়িত হয়ে পড়েন শোভাকাঙ্খি ও স্বজনরা। অমিত এর মা-বাবাকে যেন এই শোক সহ্য করার ক্ষমতা দান করেন মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা করে স্ট্যাটাস ও কমেন্ট বক্সে ম্যাসেজ করেন শোভাকাঙ্খিরা।
একই বাড়ির বাসিন্দা গুরুপদ সরকার কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন জানান- বরযাত্রীর গাড়ি বহরে আমিও ছিলাম। বরের গাড়ি অতিক্রম করে আমরা সামনে চলে যাই, কিছুক্ষণ পর বরের প্রাইভেটকার চালক আমাদের গাড়ি চালকে ফোন করে বলেন, গাড়ি ঘুড়িয়ে গৌরীপুর আসেন। বর অসুস্থ। রাজধানীর ল্যাবএইডে নেয়ার পর আর বিয়ে বাড়িতে যাওয়া হয়নি!