নিজস্ব প্রতিবেদক
দীর্ঘ ১০ বছর ধরে একই অফিসে বহাল তবিয়তে আছেন কুমিল্লার আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়ের গবেষণা কর্মকতা রওশন জাহান। আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অফিসটিতে বহাল রয়েছেন তিনি। ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে কুমিল্লা আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়ে গবেষণা কর্মকতা পদে যোগদান করেন রওশন জাহান। যোগদানের পর নিজেকে আওয়ামী পরিবারের সন্তান হিসেবে জাহির করেন তিনি। একে একে সখ্যতা গড়েন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিক উল্লাহ খোকন, আদর্শ সদর উপজেলা পরিষদের অপসারিত চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুল, মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ (জিএস সহিদ) এবং সাবেক কাউন্সিলর হাবিবুর আল আমিন সাদির সাথে।
সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের এসব ক্যাডারদের সাথে সখ্যতা তৈরির পর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন আঞ্চলিক অফিসের গবেষণা কর্মকর্তা রওশন জাহান। নিজের সহকর্মীদের ওপর কর্তৃত্ব সৃষ্টি করে একটি আতংকের পরিবেশ গড়েন এই কর্মকর্তা। সহকর্মীরা ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না।
কুমিল্লার আঞ্চলিক কার্যালয়টিতে তিনজন গবেষণা কর্মকর্তা থাকলেও বাকী দুজন ছিলেন নামে মাত্র। আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাবে সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন রওশন জাহান একাই। বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ পেতে আওয়ামীপন্থী ঠিকাদাররা গবেষণা কর্মকর্তা রওশন জাহানের প্রভাবকে ব্যবহার করতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রওশন জাহানের বাড়ি নরসিংদীতে। তার বাবা প্রয়াত সিদ্দিকুর রহমান সেখানকার প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের একজন নেতা ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আঞ্চলিক অফিসের গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের ১ বছরের মধ্যে তদবির করে ২০১৫ সালে কুমিল্লায় পোস্টিং নেন। ২০১৫ সাল থেকে এখন অবধি কুমিল্লা আঞ্চলিক অফিসের গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে স্বপদে বহাল রয়েছেন এই কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সালে ছয়বার ভারত , ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দুইবার নেপাল এবং ২০১৯ সালে চীন ভ্রমন করতে যান রওশন জাহান। তার এই ভ্রমণ নিয়েও অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছেন। তার বিরুদ্ধে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম ও কর্মক্ষেত্রে অসদাচরণের অভিযোগও পাওয়া গেছে।
নাম গোপন রাখার শর্তে কুমিল্লা আঞ্চলিক পরিচালক কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘রওশন জাহানের আচরণ অত্যন্ত উগ্র। তিনি আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান বলে সহকর্মীদের সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করতেন। উনিশ থেকে বিশ হলেই মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের দিয়ে শাসাতেন। সেসব নেতারা এখন পলাতক থাকলেও আওয়ামী লীগের দোসর এই কর্মকর্তা এখনও কুমিল্লা আঞ্চলিক কার্যালয়ে তার কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন। তার ভয়ে অফিসের ঊর্ধ্বতনরাও তটস্থ থাকেন।’
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কজন শিক্ষক বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার আচরণ এমন হয় আমরা এর আগে দেখিনি। রওশন জাহান আওয়ামী বিরোধী মত পোষণকারী শিক্ষকদের টার্গেট করতেন। সেসব শিক্ষকদের তুইতুকারি করতে বিন্দু পিছপা হতেন না। কথায় কথায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতাদের নাম নিয়ে শিক্ষকদের সাথে উচ্চবাচ্য করতেন সবসময়। বিভিন্ন প্রজেক্টের নামে আওয়ামী বিরোধী মনোভাবের শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করতেন এই কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সাত মাস পেরিয়ে গেলেও রওশন জাহান এখও স্বপদে বহাল থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষকেরা।
অপরদিকে সরকারি চাকরি বদলির আদেশ আইনের ৭ এর ক ধারায় বলা আছে- সরকারি ও বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা/দপ্তর/পরিদপ্তর এবং অন্যান্য বদলীযোগ্য কর্মকর্তা যারা একই স্থানে/একই পদে তিন বছরের অধিক সময় কর্মরত আছেন, তাদের অবিলম্বে বদলি করতে হবে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা এই আদেশের আওতাভূক্ত নয়। (২২/৫/৮৩ইং তারিখের মন্ত্রিপরিষদ সিদ্ধান্ত)।
রওশন জাহানের তিনবারের অধিক সময় বদলির সময় পার হলেও দীর্ঘ দশ বছর ধরে একই পদে একই অফিসে বহাল থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল।
কুমিল্লা কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ূন কবির মাসউদ বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী একজন সরকারি কর্মকর্তা তিন বছরের বেশি এক অফিসে একটানা চাকরি করতে পারেন না। সেখানে দীর্ঘ দশ বছর কীভাবে একজন কর্মকর্তা একই অফিসে থাকেন বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা উচিত।’
তবে অভিযোগের বিষয় উড়িয়ে দিয়ে অভিযুক্ত গবেষণা কর্মকর্তা রওশন জাহান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে এখানকার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমার ব্যক্তিগত অনেক বিষয় আছে, যা আমার ঘনিষ্ঠজন ছাড়া জানার কথা নয়। এমন কেউ হয়তো এসব অভিযোগ তুলেছে। আমি আওয়ামী পরিবারের ঠিক আছে, তবে আমি টানা ১০ বছর এই কার্যালয়ে চাকরি করছি আওয়ামী লীগের প্রভাব ছাড়াই। সরকারি চাকরি করলে সরকারি দলের অনেক কিছুই মানতে হয়, করতে হয়। আওয়ামী লীগের কোন লোকজনের সঙ্গে বর্তমানে আমার কোন যোগাযোগ নেই। কোন শিক্ষকের সঙ্গে আমি খারাপ আচরণ কখনো করিনি। এখন যদি আমাকে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান এমনকি সন্দ্বীপও বদলি করে আমি যেতে রাজি আছি, আমার কোন আপত্তি নাই।’
কুমিল্লা আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সফিকুর রহমান বলেন, ‘আমি এই কার্যালয়ে দুই মাস হয়েছে যোগদান করেছি। রওশন জাহানের বিষয়ে এমন কিছু এখনও জানিনা। অনেকেই তো নিজের সুবিধার জন্য একই জায়গায় দীর্ঘসময় চাকরি করে থাকে। তিনি হয়তো এই কারণে রয়েছেন। কাউকে বদলি বা বহাল রাখার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।’