নিজস্ব প্রতিবেদক:
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছামসুল আলমকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে।
বিভিন্ন মেয়াদে সাড়ে ১৬ বছর কুমিল্লায় চাকরি করা কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছামছুল আলমকে ওএসডি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গতকাল রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মিঞা মুহাম্মদ আশরাফ রেজা ফরিদী স¦াক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই আদেশ দেয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে এই কর্মকর্তাকে সংযুক্ত করা হয়।
জানা গেছে, ছামছুল আলমের চাকরি জীবনের শুরুটা কুমিল্লায়। দীর্ঘ এই সময়ে কখনও সহকারী কমিশনার( এসিল্যান্ড), এনডিসি, কখনও ইউএনও, কখনও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা , জোনাল সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা, সিটি করপোরেশনের সচিব এবং সর্বশেষ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। কুমিল্লা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের আস্থাভাজন সহযোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি এই কর্মকর্তা। বাহারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে সর্বশেষ তিনি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মো. ছামছুল আলম কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার হিসেবে ২০০৫ সালে যোগদান করেন। ওই বছরের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নেজারত ডেপুটি কালেক্টরেট ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পর জেলা প্রশাসকের দপ্তরের ৩৭তম এনডিসি। ২০০৭ সালের ১ জুলাই মুরাদনগর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগ দিয়ে ২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিলেন। এরপর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জোনাল সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর চান্দিনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়ে ২০১১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিলেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সচিব পদে যোগ দিয়ে ২০১৫ সালের ২ এপ্রিল পর্যন্ত এই চেয়ারে ছিলেন।
২০১৫ সালের ১৮ মে কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হিসেবে যোগ দেন। এই পদে ছিলেন ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত। ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল কুমিল্লার জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে আবারও যোগ দেন। এই চেয়ারে ছিলেন ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ২০২৩ সালের ৬ জুলাই কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হন। তখনে থেকে বর্তমানে এই পদেই কর্মরত আছেন। বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠলেও স্বপদে বহাল আছেন এই সরকারি কর্মকর্তা।
ছামছুল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তি
চেক আত্মসাতের অভিযোগ : ২০১৫ সালের ২ এপ্রিল কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন সচিব ছামছুল আলমকে রংপুর সিটি করপোরেশনের সচিব পদে বদলি করা হয়। কারণ ছিল তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য এবং আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস প্রকল্পের একজন ঠিকাদারের জামানতের দুই লাখ ৩০ হাজার টাকার চেক আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল। এ ঘটনায় সিটি করপোরেশনের ২৪ জন কাউন্সিলর তখন দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বদলির সেই আদেশ বাতিল করিয়ে স্বপদে থেকে যান তিনি।
নৌকার ভোট চেয়ে শোকজ: স্থানীয় ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের আস্থাভাজন হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের টেন্ডার দেওয়া, বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করা, ভবনের অনুমতি দিতে সহযোগিতাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে ছামছুল আলমের বিরুদ্ধে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এক অনুষ্ঠানে আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের জন্য নৌকা প্রতীকে ভোট চাওয়ায় তাকে শোকজ করেছেন কুমিল্লা-৬ নির্বাচনী আসনের অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান যুগ্ম জেলা জজ মো. সিরাজউদ্দিন ইকবাল। তখন কারণ দর্শানোর জন্যও বলা হয়। কিন্তু বাহার এমপি হয়ে গেলে তার জবাব দেওয়া লাগেনি।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজ পাওয়ার জন্য এই কর্মকর্তার ঘরের বাজার পর্যন্ত করে দিতে হতো ঠিকাদারদের। তার ঘনিষ্ঠ সহচর তুহিন ও সিটির দক্ষিণ কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে নানা দুর্নীতি করেছেন। টাকা খরচ করে এত বছর ধরে কুমিল্লায় আছেন। নিজের ও স্ত্রী নামে করেছেন কোটি টাকার সম্পদ।
দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ: সর্বশেষ গতবছরের ২ অক্টোবর দুপুরে সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে এই নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করা হয়। অনিয়ম, দুর্নীতি ও বেতন বৈষম্যসহ নয় দফা দাবি আদায়ে বিক্ষোভ করেন সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীরা। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা তার কক্ষে তালা দিয়ে অবরুদ্ধ রাখেন তারা। এ সময় হাজারো কর্মচারী সিইইউর অফিসের সামনে অবস্থান করে ভুয়া ভুয়া স্লোগান দিতে থাকেন। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টার পরে ব্যর্থ হয়। পরে সিটি করপোরেশনের প্রশাসক সাইফ উদ্দিন আহমেদ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
তখন আন্দোলনকারী কর্মচারীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে এই নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকাশ্যে দুর্নীতি করে আসছেন, আমরা তার প্রতিবাদ করতে গেলে আমাদের চাকরি হারাতে হয়।
জানতে চাইলে মো. ছামছুল আলম বলেন, আমাকে ওএসডি করা হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এদিকে তাঁর বদলির আদেশ গতকাল দুপুরের পর থেকে কুমিল্লার বিভিন্নজনের ফেসবুকে দেখা গেছে। ফেসবুকে তাঁর ওএসডির বিষয়টি নানাভাবে উপস্থাপন করেছেন নেটিজেনরা। বিকেলে নগর ভবনে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। নগর ভবনের অন্তত তিনজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিনি ডর্মেটরিতে গেছেন। সোমবারও দপ্তরে তাঁর চেয়ারে ছিলেন।
নগর ভবনের একজন কর্মচারী বলেন, ছামছুল আলমের ওএসডির খবরে কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। কুমিল্লার রাজনীতিবিদ ও সরকারের কিছু লোক তাঁকে কুমিল্লায় লালনপালন করেছেন। তিনি সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পর্যন্ত টাকা নিতেন।