চৌদ্দগ্রাম প্রতিনিধি:
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে থানা পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়ে গত শনিবার রাতে মো. ইসরাক হোসেন মজুমদার রাহীম (২১) নামে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের এক চিহিৃত ক্যাডারকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর একটি প্রভাবশালী মহলের চাপে রোববার সকালে তড়িগড়ি করে দায়সারাভাবে নামমাত্র একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করে পুলিশ। যারফলে আটককৃত ওই ছাত্রলীগ নেতা একইদিন দুপুরেই আদালত থেকে জামিনে মুক্তি লাভ করেন এবং এখনো এলাকায় বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করছেন। আর এই পুরো ঘটনার নেপথ্যে কাজ করেছেন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (চৌদ্দগ্রাম-নাঙ্গলকোট সার্কেল) নিশাত তাবাসসুম এর স্বামী চৌদ্দগ্রাম উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুুল্লাহ আল মামুন সাগর। এই ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক চাঞ্চল্যের। জনমনে দেখা দিয়েছে নানান প্রশ্ন।
জানা গেছে, গত শনিবার রাতে চৌদ্দগ্রাম থানা পুলিশ উপজেলার চিওড়া ইউনিয়নে বিশেষ অভিযান চালিয়ে মহাসড়কে নাশকতায় আশঙ্কায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করে উপজেলার ‘চিওড়া সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগ’ এর সভাপতি ইসরাক হোসেন মজুমদার রাহীমকে। গ্রেফতারকৃত রাহীম মজুমদার একই ইউনিয়নের চিওড়া গ্রামের মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে। বিগত স্বৈরাচার সরকারের আর্শিবাদপুষ্ট হয়ে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের পদ-পদবী পেয়ে আটককৃত রাহীম মজুমদার চিওড়া সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস সহ তার নিজ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তৎকালীন সময়ে সে ক্ষমতার অপব্যবহার করে চিওড়া কলেজে পড়ুয়া বিরোধী মতের রাজনৈতিক নেতাকর্মী সহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর চালাতো নানান ধরণের অত্যাচার-নির্যাতন। এছাড়াও রাহীম মজুমদারের নেতৃত্বে চিওড়া এলাকার অসংখ্য নিরীহ জনসাধারণের উপরও চলতো বর্বরোচিত অত্যাচার-নির্যাতন। এমন সব ঘৃণিত কাজ করতো সে তৎকালীন চৌদ্দগ্রাম উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক কাউছার হানিফ শুভ ও ইউনিয়ন যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা, ধোড়করা বাজারের ব্যবসায়ী মো. রাসেল হায়দারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে। তার নেতৃত্বেই এলাকায় মাদক ব্যবসাসহ নানান অপকর্ম চলতো। তার নানামুখী অত্যাচারে এলাকার সাধারণ জনগণ খুবই অতিষ্ঠ ছিল। ছাত্রলীগ নেতা রাহীম মজুমদারের নেতৃত্বে গড়ে উঠা ছাত্রলীগের একটি ক্যাডার বাহিনী চিওড়া সহ আশে-পাশের বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দিয়ে আতংক সৃষ্টি করে বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়াতো। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সকালেও চৌদ্দগ্রাম বাজারে চলে তার নেতৃত্বে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মহড়া। তারা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিয়ে চৌদ্দগ্রাম বাজার সহ চিওড়া এলাকায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ৫ আগস্ট বিকালে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকার এর পতন হলে চৌদ্দগ্রামের আওয়ামীলীগ দলীয় অন্যান্য নেতাকর্মীদের মত সেও নিজ এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যায়। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর এলাকার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে সম্প্রতি সে আবার নিজ এলাকায় ফিরে আসে এবং প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে দেখা যায় তাকে। এ সময় উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত কয়েকটি ফুটবল টুর্ণামেন্টের ম্যাচে সরাসরি খেলতে দেখা গেছে তাকে। এরই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার (১৫ আগস্ট) উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী খেলায় চৌদ্দগ্রাম উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন সাগরের দলে স্বশরীরে খেলতে দেখা গেছে তাকে। সেই খেলায় পুলিশের চৌদ্দগ্রাম-নাঙ্গলকোট সার্কেলের এএসপি নিশাত তাবাসসুম, তার স্বামী চৌদ্দগ্রাম উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন সাগর ও চৌদ্দগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ হিলাল উদ্দিন আহমেদ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। ফুটবল দলে খেলার সুবাধে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সাথে গড়ে উঠে তার দারুণ সখ্যতা ও গভীর সম্পর্ক। ছাত্রলীগের পরিচয় পেয়ে রাহীম মজুমদারকে আরও আপন করে নেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন সাগর।
এদিকে প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে বসে অনুসারীদের নিয়ে দেশ বিরোধী নানান ষড়যন্ত্র ও মহাসড়কে নাশকতা সহ সন্ত্রাসী হামলার ছক আঁকতে শুরু করে রাহীম মজুমদার। একপর্যায়ে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে তালিকাভুক্তি, রাষ্ট্র বিরোধী বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করা সহ মহাসড়কে নাশকতা চালানোর আশঙ্কায় চৌদ্দগ্রাম থানা পুলিশ তাকে খুঁজতে থাকে।
চৌদ্দগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মুরাদ হোসেন ও সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. হারুন অর রশিদ এর নেতৃত্বে থানা পুলিশের একটি আভিযানিক চৌকস টিম গত শনিবার রাতে চিওড়া গ্রামের কুঁড়ি পুকুরপাড় এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর থেকেই তাকে ছাড়ানোর জন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন সাগর তার স্ত্রী চৌদ্দগ্রাম-নাঙ্গলকোট সার্কেলের এএসপি হিসেবে কর্মরত নিশাত তাবাসসুমের পরিচয় ব্যবহার করে থানা পুলিশের কাছে বিভিন্ন তদবীর শুরু করেন। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতা রাহীম মজুমদারের গ্রেফতারের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে এবং এলাকায় জানাজানি হয়ে যাওয়ায় থানা প্রশাসন বেঁকে বসে। পুলিশের পক্ষ থেকে রাহীম মজুমদারকে ছাড়ার বিষয়টি সরাসরি নাকচ করে দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। একপর্যায়ে নিজ স্ত্রীকে দিয়ে তদবীর করেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন। এতে কাজও হয় বটে। উপরের নির্দেশ পেয়ে দায়সারা একটি মামলা দিয়ে আটককৃত রাহীম মজুমদারেক রোববার সকালেই তড়িগড়ি করে আদালতে প্রেরণ করতে বাধ্য হয় থানা পুলিশ। এদিকে আদালতে প্রেরণের আগেই পরিবারের পক্ষ থেকে আটককৃত রাহীম মজুমদারের জন্য জামিনের সকল ব্যবস্থা করে রাখা হয়। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লার ০৯নং আমলী আদালতে আসামীকে হাজীর করা হলে জামিন চায় আসামী পক্ষের উকিল। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে আনিত অভিযোগ অতটা গুরুতর না হওয়ায় আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। ছাড়া পাওয়ার পর এলাকায় বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করছে এখন সে।
জানা গেছে, থানা পুলিশের পক্ষ থেকে আসামীর সাথে আদালতে পাঠানো মামলার চালান ফরোয়ার্ডিংয়ে রাহীম মজুমদারের ছাত্রলীগ নেতার পরিচয়টি কৌশলে গোপন রাখা হয়। সহজ শর্তে আদালত থেকে জামিন লাভে সহযোগিতায় এটি করা হয় বলে সচেতন মহল মনে করছে। কিন্তু বিগতদিনে পুলিশ জামায়াত-বিএনপি’র কোনো নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করলেই আদালতে পাঠানো চালান ফরোয়ার্ডিংয়ে পদ-পদবী সহ তার রাজনৈতিক পরিচয়টি উল্লেখ করে দিত। যাতে আসামীকে উপস্থাপিত আদালতের বিচারক চালান দেখেই বুঝতে পারেন আটককৃত ব্যক্তি বিরোধী দলীয় শীর্ষ পদধারী লোক। এক্ষেত্রে আদালত বেশিরভাগ সময়ই জামিন নামঞ্জুর করে আসামীকে জেলহাজতে প্রেরণ করে দিতেন। অথচ জুলাই অভূ্যত্থানের পর ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটলো নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা রাহীম মজুমদারের বেলায়। আর এটি সম্ভব হয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তির তদবীর আর উপর মহলের ইশারায়। যারফলে আদালতে উপস্থাপনের পর জামিন চাওয়া হলে বিচারক তাকে স্বাভাবিকভাবেই জামিন দিয়ে দেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা রাহীম মজুমদারের জন্য তদবীরকারী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন নিজেও ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগের দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ছিলো তার দারুন সখ্যতা। তার ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে এখনো ফ্যাসিস্টদের সাথে তোলা বেশকিছু ছবি ভাসতে দেখা গেছে। চৌদ্দগ্রামে বদলী হয়ে আসার পর থেকে তার বিভিন্ন কর্মকান্ডে ফ্যাসিজম ফুটে উঠেছে। নিজ কার্যালয়ে কর্মরত অধিনস্থদের জামায়াত-বিএনপি তমকা দিয়ে কটাক্ষ করতেও শোনা গেছে তার ব্যাপারে। বাড়ি গিয়ে প্রাণির স্বাস্থ্য সেবা দিতে গেলে গ্রাহকদের থেকে মোটা অংকের টাকা নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ সহ হাসপাতালে সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চৌদ্দগ্রামের সাধারণ মানুষ তার মত এমন পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরকে আর চৌদ্দগ্রাম প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে দেখতে চায়না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন সাগর বলেন, আটককৃত ছাত্রলীগ নেতা রাহীম মজুমদার গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে ছাড়ানোর জন্য কয়েকজন লোক আমার কাছে এসেছিল। কিন্তু আমি যখন খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছি সে ছাত্রলীগ করতো, তখন তার ব্যাপারে কোন তদবীর করিনি।
আপনার ফুটবল টিমের হয়ে কিভাবে একজন ছাত্রলীগ ক্যাডার বিভিন্ন স্থানে খোলামাঠে ফুটবল খেলে? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রথমে তিনি নিজদলে খেলার বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে আমাদের কাছে এ ব্যাপারে ছবি-ভিডিও সহ যথেষ্ট পরিমান ডকুমেন্ট থাকার কথা জানালে রাহীম মজুমদার তার ফুটবল টিমে খেলার বিষয়টি তিনি অকপটে স্বীকার করে নেন।
চৌদ্দগ্রাম-নাঙ্গলকোট সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নিশাত তাবাসসুম বলেন, শুক্রবার ও শনিবার আমি ছুটিতে ছিলাম। এমন কোন তদবীর বা আটকের বিষয় আমার জানা নেই।
এ বিষয়ে চৌদ্দগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ হিলাল আহমেদ বলেন, ছাত্রলীগ নেতা ইসরাক হোসেন রাহিম মজুমদারকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে গ্রেফতার করে আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। তাকে ছাড়ানোর বিষয়ে আমাদের কাছে কোন ধরনের তদবীর ছিল না। জামিন দেওয়ার বিষয়টি একান্তই আদালতের ব্যাপার।