নেকবর হোসেন
কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের পেছনের দিকে বহির্বিভাগের দুটি কক্ষের সামনে কর্মদিবসের সবসময়ই রোগীদের লম্বা সারি থাকে। খোলা আকাশের নিচে সে লাইনে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই অপেক্ষা করেন মানুষ। কারণ টিনশেড ভবনের ওই দু’কক্ষে বসেন মেডিসিন বিভাগের ৯ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
চিকিৎসক মো. আল মামুন আক্ষেপ জানিয়ে বলেন, ুকিছুই করার নাই। এই রুমগুলোতে মানুষ দাঁড়ানোরও জায়গা নেই। তার উপর এখানে নার্সদেরও বসার জায়গা দিতে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, এটা সেবা দেওয়ার কোনো পরিবেশ না। মনোযোগ দিয়ে রোগী দেখা কষ্টকর।”
দেড়শ বছরের পুরানো এই স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রটি কুমিল্লা সদর হাসপাতাল নামেই বেশি পরিচিত। মাত্র ৫০ শয্যার হলেও জেলার অন্যতম সরকারি হাসপাতালটির বহির্বিভাগে বছরে চিকিৎসা নেন কয়েক লাখ মানুষ। ২০২৩ সালে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছিলেন ৩ লাখ ৩৯ হাজার মানুষ, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৩ লাখে। আর এ বছরের সাত মাসেই চিকিৎসা নিয়েছেন ২ লাখ ৩০ হাজার রোগী।
তবে প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে রোগী বেড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটি ধুঁকছে চরম অবকাঠামো সংকটে। এতে রোগীদের যেমন নানান অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে, তেমনি সেবা দেবার সুষ্ঠু পরিবেশ পাচ্ছেন না চিকিৎসকরাও।
তাই হাসপাতালটিকে অন্তত আড়াইশো শয্যায় উন্নীত করা প্রয়োজন জানিয়ে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও জেলা সিভিল সার্জন আলী নূর মোহাম্মদ বশির বললেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। যতদ্রুত অনুমোদন পাওয়া যাবে- তত দ্রুত সঙ্কট কাটবে।
তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, ১৮৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি বাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮৭১ সালের দিকে কুমিল্লা দাতব্য চিকিৎসালয়ের নামে প্রতিষ্ঠানটিতে রোগী ভর্তি শুরু করা হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠানটি ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে পরিণত হয়। যা বর্তমানে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল বা সদর হাসপাতাল নামে পরিচিত।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর এই জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগেই সবচেয়ে বেশি রোগী হচ্ছে। এখানে পাঁচ টাকার টিকেটে বহির্বিভাগ ও সরকারি খরচে আন্তঃবিভাগ চালু রয়েছে।
৪৯ চিকিৎসকের জন্য কক্ষ ১৯টি
বর্তমানে বহির্বিভাগে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, অর্থোপেডিক্স, নাক-কান-গলা, চক্ষু, চর্ম ও যৌন, ফিজিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসা দেয়া হয়।
কিন্তু এসব বিভাগের সরকারি ৩৩ জন এবং অবৈতনিক ১৬ জনসহ সর্বমোট ৪৯ জন চিকিৎসকের জন্য রয়েছে মাত্র ১৯টি কক্ষ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, টিনশেড ভবনে যে দুই কক্ষে ৯ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। যেখানে রোগী বসার জায়গা পর্যন্ত নেই। চেয়ার টেবিলগুলোও যেন বয়সের ভারে রঙচটা হয়ে গেছে।
সামনের দিকে পুরোনো ভবনের চিকিৎসকদের কোনো কোনো কক্ষে নেই রোগী শোবার বিছানাও। পুরোনো স্যাঁতস্যাঁতে ভবনের কক্ষগুলোতে আলোর অভাব। প্রাথমিক চিকিৎসায় নেই উন্নত-যন্ত্রপাতি।
পর্যাপ্ত বিশ্রামের জায়গা না থাকায়, গাছের নিচে-পুকুর পাড়ে অপেক্ষা করতে হয় রোগী ও স্বজনদের। বেশি অসুস্থদের অপেক্ষা করতে হয় মেঝেতে বসে, অটোরিকশা কিংবা সিএনজিতে বসে। বেশি অসুবিধায় পড়েন বৃদ্ধ কিংবা শিশুরা। বৃষ্টি, প্রচণ্ড রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় যেন আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন তারা।
সম্প্রতি বহির্বিভাগের সামনে গিয়ে কথা হয় চান্দিনা উপজেলা থেকে আসা আশা বেগমের সঙ্গে। তিনি ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত ৬০ বছর বয়সী মা নাজমা বেগমকে নিয়ে এসেছেন থেরাপি দিতে।
আশা বলেন, সকাল ৭টায় মাকে নিয়ে এসে বারান্দায় অপেক্ষা করছি। সকাল সাড়ে ১০টায় সময় পেয়েছি। এই সময়টা প্রচণ্ড গরমের মধ্যে সিমেন্টের চেয়ারে বসে আছি। মায়ের দুই হাত পা অবশ, এভাবে কষ্ট করে কতক্ষণ বসে থাকা যায়?”
সবচেয়ে বেশি রোগীর ভিড় হয় চর্ম ও যৌন বিভাগে৷ এ বিভাগে বাবাকে নিয়ে আসা মহিবুল আলম বলেন, ুবাবা বয়স্ক মানুষ, চর্ম রোগে আক্রান্ত। উনি পুকুর পাড়ে বসে অপেক্ষা করছেন, আমি সিরিয়ালের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি এসেছিল, বৃষ্টিতে ভিজেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।”
তিনি বলেন, ুএখানে ডাক্তার ভালো, সেবাও ভালো- কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি। তাই রোগীদের ভোগান্তি হচ্ছে।ু
শিশু বিভাগের সামনে এক বছর বয়সী বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সামিনা আহমেদ বলেন, ুগরমে শিশুদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। আর ছাউনির নিচে এখানে কোনো ফ্যান নেই। অনেক শিশুর বয়স অনেক কম, তাদের জন্য একটু ঠান্ডা পরিবেশও দরকার হয়।”
রোগীর তুলনায় চিকিৎসকও অপ্রতুল
গত ১৭ অগাস্ট হাসপাতালের বহির্বিভাগে টিকিট কেটেছেন ১৯ হাজার ৩১ জন। তার বিপরীতে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছেন দায়িত্বরত চিকিৎসকরা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী আসে তার জন্য চিকিৎসক সংখ্যা অপ্রতুল। ফলে কোনো দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তকে সময় দিয়ে সেবা দিতে হলে অন্য রোগীদের অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। একটি বিভাগে অন্তত পাঁচজন চিকিৎসক থাকলে কোনোরকমে চাপ সামলে নেওয়া যায়।
এ হাসপাতালের চর্ম রোগের বিভাগে প্রতিদিন গড়ে চারশত রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এই রোগীদের জন্য অন্তত ছয় থেকে আট জন চিকিৎসকের প্রয়োজন। কিন্তু এ বিভাগে চিকিৎসক মাত্র তিনজন, তাও তারা সংযুক্তিতে রয়েছেন।
মেডিসিন বিভাগের সমসংখ্যক রোগীর জন্য পদায়নকৃত চিকিৎসক আছেন মাত্র তিনজন, বাকিরা সংযুক্তিতে। এ বিভাগের জন্যই পদায়নকৃত অন্তত ছয়জন চিকিৎসক প্রয়োজন।
শিশু বিভাগে রয়েছেন মাত্র দুজন পদায়নকৃত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যেখানে গড়ে রোগী হয় প্রতিদিন আড়াইশ। এই বিভাগে অন্তত পাঁচ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজন বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার মো. রাসেল খান বলেন, সরকারি খরচে মানুষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা নিতে পারছে; বিনামূল্যে অপারেশন হচ্ছে-ঔষধ পাওয়া যাচ্ছে। তাই প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হলেই, চিকিৎসক বাড়িয়ে এ হাসপাতালে আলাদা আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তাহলে প্রতিষ্ঠানটি কুমিল্লার মানুষের স্বাস্থ্যসেবার সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারতো। তারপরও মানুষ আসে, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি।”
তবে বহির্বিভাগের একাধিক রোগী বললেন, চিকিৎসক বাড়ালে রোগীর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। সাধারণ মানুষের সেবার মান আরও বাড়বে। কিন্তু চিকিৎসক আসলে তারা বসবেন কোথায়?
এই প্রশ্ন চিকিৎসকদেরও। যেখানে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের আলাদা আলাদা সাজানো-গোছানো কক্ষ থাকে, সে তুলনায় এখানের পরিবেশ গণরুমের মত।
আবাসিক মেডিকেল অফিসার আব্দুল করিম খন্দকার বলেন, ুরোগীর সংখ্যা বাড়ছে মানে সেবার মান বাড়ছে। হাসপাতালটার স্থাপনা খুবই দুর্বল। চাইলেও আমরা বেশি ডাক্তার দিতে পারছি না।
কাউন্টারে ভিড় কমাতে আরও কাউন্টার করলেও লাভ নাই, কারণ ডাক্তার নাই। আবার যে জায়গায় একজন ডাক্তার সেবা দেবার কথা সেখানে দুই-তিনজন বসে- এটা শুধু স্থাপনার অভাবে। যখন হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত হবে তখন এসব সমস্যা কমে আসবে।”
সেবা দানের পরিবেশ নিয়ে ক্ষোভ:
দিন দিন চিকিৎসা সেবার খরচ বাড়তে থাকায়- এখন সরকারি হাসপাতাল মুখী হচ্ছেন মধ্যবিত্তরাও। তাই আগের তুলনায় সরকারি চিকিৎসকের কাছে সেবা নিতে আসার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানালেন কুমিল্লার জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ইকবাল আনোয়ার।
জেনারেল হাসপাতালে সেবা দানের পরিবেশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, একজন চিকিৎসককে তার কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। রোগীকে যেন তিনি মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করতে পারেন সেজন্য তাকে সময়ও দিতে হবে।
কিন্তু কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালে যেভাবে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেজন্য চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। না হয় চিকিৎসকরা মনোযোগ হারিয়ে ফেলতে পারেন।”
ইকবাল আনোয়ার আরও বলেন, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল জেলার অন্যতম সরকারি চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র। বিভিন্ন উপজেলা থেকেও রোগীরা আসেন এখানে চিকিৎসা নিতে।
দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীদের কথা বিবেচনায়ও খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। না হয় চিকিৎসা নিতে আসা লোকজন আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। যেটা আমরা একজন চিকিৎসক হিসেবে মেনে নিতে পারি না।
এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীদের জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, এমন গাদাগাদি পরিবেশে যা কখনোই সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন প্রবীণ এই চিকিৎসক।
কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ও কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক আলী নূর মোহাম্মদ বশির জানান, ১৬৫ বছর বয়সী হাসপাতালটিতে ক্যাম্পাসে ৫ একর জায়গা রয়েছে। হাসপাতালটিকে ২৫০ শয্যা হাসপাতালে উন্নীত করণের জন্য আবেদন করা হয়েছে মন্ত্রণালয়। যত দ্রুত এই প্রকল্প অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন হবে কুমিল্লার মানুষ তত ভালো সেবা পাবেন।
একই রুমে একাধিক চিকিৎসক বিষয়টি মেনে নেয়া যায় না মন্তব্য করে সিভিল সার্জন বলেন, আমাদের আসলেই কিছু করার নেই। প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার রোগীর চাপ সামলাতে আমাদের একই রুমে দুইজন বা তিনজন চিকিৎসক বসতে হচ্ছে।