গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
পশ্চিম আকাশে এক চিলতে বাঁকা চাঁদের হাসিতে মাহে রমজানের চাঁদ দেখার অপেক্ষায় মুসলিম বিশ্ব। মাহে রমজান মানেই ইবাদত - বন্দেগীর বসন্তকাল।
প্রতিবছর রমজান আসে মুমিনের হৃদয়মিনারে পুণ্যের প্রোজ্জ্বল প্রদীপ হয়ে। রমজান আসে সাম্য-মৈত্রীর বিধান নিশ্চিতকরণের দৃপ্ত শপথ নিয়ে। তাই তো ব্যস্ত কবিও রমজানকে বরণ করে নেয় তাঁর কবিতার ছন্দের মাধ্যমে, 'তোমারে সালাম করি নিখিলের হে চির কল্যাণ,/জান্নাতের পুণ্য অবদান।'
রমজান কল্যাণ, ক্ষমা ও মুক্তির মাস, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির মাস। এ মাসের মর্যাদা অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক। এ মাস সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি রমজান মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নফল কাজ করবে, সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল।'(মিশকাত শরিফ, হাদিস: ১৮৬৮)
রমজান শুদ্ধতার মাস। প্রতিবছর রমজান আসে, রমজান যায়, কিন্তু আমরা কি শুদ্ধ হতে পারি? রমজান আত্মসংযমের মাস। কিন্তু আমরা কি আত্মসংযমী হতে পারি? রমজান সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, পরোপকার, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মাস। কিন্তু আমরা কি নিজেদের মধ্যে এসব গুণ অর্জন করতে পারি? আমরা বরং রমজানকে কেন্দ্র করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করি।
প্রতিবছর রমজান এলেই এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লাগামহীন হয়ে পড়ে।
অথচ যারা এভাবে পণ্য মজুদ রেখে অর্থ উপার্জন করে, তাদের অর্থকড়ি সম্পূর্ণ হারাম। হাদিসে এসেছে, 'জনগণের জীবিকা সংকীর্ণ করে খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করা প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে এসেছে, 'জনগণের জীবিকা সংকীর্ণ করে যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে সে অপরাধী। আর জেনে রাখো, সে গুনাহগার সাব্যস্ত হবে।' (মুসলিম শরিফ, হাদিস: ১৬০৫)
অন্য হাদিসে এসেছে, 'যে ব্যক্তি আমদানি করবে সে রিজিকপ্রাপ্ত হবে, আর যে ব্যক্তি গুদামজাত করবে, সে অভিশপ্ত হবে।' (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২১৪৪)
অন্যদিকে সমাজে যারা বিত্তবান, খাবারের সময় তারা হয়ে পড়েন অসংযমী। ইফতার-সাহরিতে ১০-২০ পদ খাবার নিয়ে বসেন। যতটুকু-না খান, তার চেয়ে বেশি অপচয় করেন। অথচ অপচয জঘন্য অপরাধ। আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা বলেন, 'তোমরা খাও ও পান করো এবং কোনো অবস্থায়ই অপচয় করো না। আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।'(সুরা, আরাফ, আয়াত: ৩১)
মহানবী (সা.)-এর ইফতার ছিল খুবই সাদাসিধা। খেজুর, ছাতু আর পানির ইফতার। হাদিসে এসেছে, রোজার মাসে রাসুল (সা.) মাগরিবের আগে কয়েকটি ভেজা খেজুরের মাধ্যমে ইফতার করতেন। ভেজা খেজুর না থাকলে সাধারণ শুকনো খেজুর। এর ব্যতিক্রম হলে কয়েক ঢোক পানিই ছিল রাসুল (সা.)-এর ইফতার। হযরত আবদুল্লাহ বিন আবি আউফা (রা:) থেক বর্ণিত। তিনি বলেন, 'রোজায় আমরা রাসুল (সা.)-এর সফরসঙ্গী ছিলাম। সূর্যাস্তের সময় তিনি একজনকে ডেকে বললেন, ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতার পরিবেশন করো।'(মুসলিম শরিফ, হাদিস: ১০৯৯)
অন্যকে ইফতার করানো সওয়াবের কাজ। মহানবী (সা.) বলেন, কেউ যদি রমজান মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহ মাফ করেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। ইফতার প্রদানকারী একটি রোজার সাওয়াব পাবে অথচ রোজা পালনকারীর সাওয়াব কমবে না। সাহাবিরা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমাদের এমন সামর্থ্য নেই, যা দিয়ে আমরা কাউকে ইফতার করাতে পারি? তিনি বলেন, আল্লাহ তাকেও এই সাওয়াব দেবেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজা পালনকারীকে এক ঢোক দুধ অথবা একটি শুকনো খেজুর কিংবা এক চুমুক পানি দিয়েও ইফতার করাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে পরিতৃপ্তি সহকারে খাওয়াবে আল্লাহ তাকে হাউসে কাওসার থেকে এমনভাবে পানি পান করাবেন, যার ফলে সে জান্নাতে না পৌঁছানো পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না। (বায়হাকি ও মিশকাত)
মাহে রমজানের রোজা উপলব্ধি জোগায় , যারা দুই বেলা দুই মুঠো খেতে পায় না, তাদের ক্ষুধার জ্বালা কতটা কষ্টের! পবিত্র রমজান অভাবহীনদের শিক্ষা দেয় সমাজের দারিদ্র্যপীড়িত, ক্ষুধাতুরদের অবস্থা অনুধাবন করে তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে। তাদের সঙ্গে সহানুভূতি ও মমত্ববোধের সেতুবন্ধ তৈরি করতে। তাই বলা যায়, মাহে রমজান সাম্য-মৈত্রীর অনন্য মাধ্যম। আত্মসংযম আর আত্মশুদ্ধির মহান বার্তা নিয়ে পবিত্র রমজান আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়ছে। নিজেদের গঠন করার এখনই সুবর্ণ সুযোগ।
তাই আসুন! অন্তত এই রমজানে নিজেদের শুধরানোর দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করি। মানবতার ধর্ম ইসলাম সাম্য-মৈত্রীর যে মহান শিক্ষা দিয়েছে তা বাস্তবায়ন করি।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এই পৃথিবীতে আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জনে পরকালের সুখময় জীবন লাভ করা। আর মানবসেবা বা পরোপকার হচ্ছে সেই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার শ্রেষ্ঠ উপায়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, 'একজন মুসলমানের সদকা তার হায়াত বৃদ্ধি করে, অপমৃত্যু থেকে বাঁচায়। তার থেকে অহংকার ও অহমিকা দূরীভূত করে।' (মুজামুল কাবির, হাদিস: ১৩৫০৮)
আসুন, নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত না থেকে আমাদের পাশের বাড়ির যে লোকগুলো না খেয়ে পড়ে আছে, তাদের নিয়েও একটু ভাবি। তাদের পাশে দাঁড়াই। তাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়াই। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, 'মহানবী (সা.) ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমজানে তাঁর বদান্যতা আরো বেড়ে যেত।' (মুসলিম শরিফ, হাদিস: ৩২০৮)
পরিশেষে মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা, পবিত্র মাহে রমজান আমাদের প্রত্যেকের জন্য বয়ে আনুক শান্তি ও সুখের বার্তা। কল্যাণময় হয়ে উঠুক আমাদের সবার জীবন। আমিন।।