গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
আজ ১৪ শাবান, শুক্রবার দিবাগত রাত পবিত্র শবে বরাত। অর্থাৎ শাবান মাসের অর্ধেক আমাদের কাছ থেকে চলে গেছে। আর মাত্র কয়দিন পর আমাদের কাছে রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের পয়গাম নিয়ে হাজির হবে মাহে রমজান।
মাহে রমজানের প্রস্তুতির মাস শাবান। এই মাসের চাঁদ মুমিনের জন্য রমজানের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। রাসূল সা. শাবান থেকেই রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন এবং অন্যদেরকে উৎসাহিত করতেন। রাসূল সা.-এর জীবনযাপনের প্রতিটি মুহূর্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষণীয়।
স্বাভাবিক জীবনযাপনের মাঝেই তিনি প্রতি মাসে আইয়ামে বীজের তিন দিন ও প্রতি সপ্তাহে দুই দিন নফল রোজা রাখতেন। তবে শাবান মাসে এই নফলগুলো ছাড়াও তার রোজা রাখার পরিমাণ বেড়ে যেতো। রমজানের পরে রমজান মাস শুরুর আগে শাবান মাসে তিনি সব থেকে বেশি পরিমাণ রোজা রাখতেন। রাসূল সা.-এর আমলগুলো তার সহধর্মীনিগণ বেশি কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেতেন। রাসূল সা.-এর দুই সহধর্মীনীর কাছ থেকে শাবান মাসে তাঁর বেশি বেশি রোজা রাখার কথা বর্ণিত হয়েছে। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
নবী (সা.) শাবান মাসের চেয়ে বেশি রোজা কোনো মাসে রাখতেন না। তিনি পুরো শাবান মাসই রোজা রাখতেন এবং বলতেন, তোমাদের মধ্যে যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটুকু (নফল) আমল করো, কারণ তোমরা (আমল করতে করতে) পরিশ্রান্ত হয়ে না পড়া পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা (সওয়াব) দান বন্ধ করেন না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৭০)।
আরেক হাদিসে উম্মে সালমা (রা.) বলেন— আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে শাবান ও রমজান মাস ছাড়া অন্য কোনো দুই মাস একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৩৬)
রাসূল সা. শাবান মাসে এতো বেশি রোজা রাখার অন্যতম কারণ ছিল রমজানের প্রস্তুতি। রমজানে রোজা রাখতে যেন তেমন কষ্ট না হয় এবং রমজান মাস ইবাদতের উপযোগী হয়ে উঠে তাই রাসূল সা. এই মাসে রোজা রাখতেন।
সাধারণভাবে খেয়াল করলে আমরা নিজেরাও অনুভব করতে পারবো বিষয়টি— রমজানের প্রথম দিনগুলোতে পিপাসা, ক্ষুধায় কিছুটা কষ্ট হয় আমাদের। এরপর স্বাভাবিক হয়ে যায় সবকিছু। রমজানের শেষ দশকে রোজা প্রত্যেকের স্বাভাবিক রুটিনে পরিণত হয়। কোনো ধরনের কষ্ট অনুভূত হয় না। তখন কারো কারো অনুভূতি এমন থাকে যে, মাসের হিসেবে রমজানের দিন সংখ্যা ৩০-এর বেশি হলেও তেমন কোনো সমস্যা হতো না।
এ বিষয়টি থেকে সহজেই অনুমান করা যায়— শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখলে রমজান মাস আমাদের ইবাদতের জন্য পুরোপুরি উপযোগী হয়ে উঠবে। একটি হাদিসেও এমন ইঙ্গিত রয়েছে—উসামা বিন জায়েদ (রা.) বলেন, আমি প্রিয় রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছি, হে আল্লাহর রাসুল, শাবান মাসে আপনি যেভাবে রোজা রাখেন, সেভাবে অন্য কোনো মাসে রোজা রাখতে আপনাকে দেখিনি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, রমজান ও রজবের মধ্যবর্তী এই মাসের ব্যাপারে মানুষ উদাসীন থাকে। এটা এমন এক মাস, যে মাসে বান্দার আমলকে বিশ্বজগতের রব আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আমি চাই, আল্লাহর কাছে আমার আমল এমন অবস্থায় পেশ করা হোক, যখন আমি রোজাদার। (নাসাঈ, হাদিস : ২৩৫৭)।
রমজানের প্রস্তুতির জন্য আরেকটি উত্তম কাজ হতে পারে শাবান মাসের তারিখের হিসাব রাখা। মুসলমানদের জন্য চন্দ্রমাসের হিসাব রাখা ফরজে কেফায়া। অনেকেই তা রাখেন। তবে রমজানের আগমনের সঠিক হিসাব রাখার জন্য শাবান মাসের তারিখের হিসাব রাখা যেতে পারে।
রাসূল সা. নিজেও শাবান মাসের শেষে রমজানের চাঁদ দেখার কথা বলেছেন এবং চাঁদ দেখেই রোজা শুরু এবং ঈদ পালনের কথা বলেছেন। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসের তারিখ এতটাই মনে রাখতেন, যতটা অন্য মাসের তারিখ মনে রাখতেন না। শাবানের ২৯ তারিখ চাঁদ দেখা গেলে পরের দিন রমজানের রোজা রাখতেন। আর সেই দিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে শাবান ৩০তম দিন পূর্ণ করে রমজানের রোজা শুরু করতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৩২৭)।
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে এত দীর্ঘ সময় সেজদায় রইলেন যে, আমার ধারণা হলো, হয়তো তিনি আর নেই। তখন আমি তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিয়ে দেখলাম। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, তোমার কি আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না হে আল্লাহর রাসুল! আপনার দীর্ঘ সেজদায় আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি বেঁচে আছেন কিনা। তখন রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত অর্থাৎ শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন, বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই’ (শুয়াবুল ঈমান : ৩৫৫৪)।
শবে বরাতে নবীজি (সা.) রাতভর ইবাদত করতেন এবং দিনের বেলা রোজা রাখতেন। উম্মে সালমা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে শাবান ও রমজান ছাড়া দুই মাস একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি। (আবু দাউদ : ২৩৩৬)।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুণাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ৭৩৯)।
শবে বরাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করা। কারণ, বরকতময় এই রাতে আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে এসে বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন। তাদের গোনাহগুলো মাফ করেন। হাদিস শরিফে বিবৃত হয়েছে, রাসুল (সা.) বললেন, ‘যখন অর্ধ শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে অবস্থান করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া অন্যদের ক্ষমা করে দেন।’ (মুসনাদে বাজজার : ৮০) ।
রাসূল সা. রমজানের ফজিলত, আমল, ইবাদত, বিধি-নিষেধ এই মাস থেকে বলতে শুরু করতেন এবং সাহাবিদের রোজা রাখতে উৎসাহিত করতেন।
আজ ১৪ শাবান দিবাগত রাত পবিত্র শবে বরাত। অর্থাৎ এ মাসের অর্ধেকও চলে গেল। পবিত্র মাহে রমজান পেতে আর মাত্র ১৪ থেকে ১৫ দিন আছে আমাদের হাতে। সুতরাং সর্বাত্মক রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের বাকী দিনগুলো আসুন যথাযথ ভাবে কাজে লাগাই। মহান আল্লাহ তায়ালা সেই তাওফিক দান করুন, আমিন।।